চীনের তিব্বতীয় মালভূমি থেকে নেওয়া দুটি বরফের নমুনায় প্রায় ১৫,০০০ বছর পুরোনো ভাইরাস খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। নমুনা থেকে প্রাপ্ত কোনো ভাইরাসই মৃত নয়। সেই ভাইরাসগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই হিমায়িত থাকার দরুন টিকে থাকতে পেরেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভাইরাসই মানুষের কাছে অজানা ছিল।
জুন ২০, ২০২১ তারিখে Microbiome জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করতে পারে যে কীভাবে কয়েক শতাব্দী ধরে ভাইরাস বিবর্তীত হয়েছে। এই গবেষণার জন্য, বিজ্ঞানীরা হিমবাহের বরফে থাকা জীবাণু এবং ভাইরাসকে কোনো প্রকার অপদ্রব্য মিশে যাতে দুষিত না হয়ে যায় সেভাবো বিশ্লেষণের করার একটি নতুন পদ্ধতিও তৈরি করেছেন। নতুন এই মেটাজেনমিক্স পদ্ধতির ফলে জীবাণুমুক্ত নমুনা থেকে গবেষকরা ঠিক ‘কি কারণে ঠান্ডার মধ্যে ভাইরাস টিকে থাকে’ তা সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা অর্জনের জন্য কাজ করতে পারবেন।

ছবি: Lonnie Thompson
নতুন গবেষণায়, দলটি তিব্বতীয় মালভূমির গুলিয়া আইস ক্যাপ (35°17′ উত্তর, 81°29′ দক্ষিণ) এলাকা থেকে কয়েক হাজার অনন্য ১৫,০০০ বছরের পুরনো ভাইরাসের সংরক্ষণাগার সনাক্ত করতে এবং তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে আরো বিস্তার জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
আরো পড়ুন: ২৪,০০০ বছর পরে আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো হিমায়িত বহুকোষী অনুজীব
ওহাও স্টেট ইউনিভার্সিটির বাইর্ড পোলার অ্যান্ড ক্লাইমেট রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ঝি-পিং ঝং বলেন, “এই হিমবাহগুলি ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল এবং এর ফলে ধুলা ও গ্যাসের পাশাপাশি অনেক ভাইরাসও সেই হিমবাহের বরফে জমা হয়েছিল। পশ্চিমা চীনের হিমবাহগুলিতে ভালভাবে গবেষণা করা হয়নি এবং আমাদের লক্ষ্যটি অতীতের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে এসব গবেষণা করে সেসকল তথ্য ব্যবহার করা। এবং এখানে ভাইরাস হলো সেই পরিবেশের একটি অংশ”
গবেষকরা পশ্চিম চীনের গুলিয়া আইস ক্যাপ থেকে ২০১৫ সালে তোলা বরফ খন্ড নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। বরফ খন্ড উচ্চ উচ্চতা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলে – একেবাড়ে গুলিয়ার চূড়া থেকে, যেখানে এই বরফ জমে তৈরি হয়েছিলো। চূড়াটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২,০০০ ফুট উপরে। আইস কোর বা বরফে খন্ডে অনেগুলো স্তর থাকে যা বছরের পর বছর ধরে জমে হয়। এবং প্রতিটি স্তর হিমায়িত হওয়ার সময় তাদের চারপাশের বায়ুমণ্ডলে যা থাকতো তা আটকে যেতো। এই স্তরগুলি বিভিন্ন সময়ের একটি টাইমলাইন তৈরি করে। এ থেকে বিজ্ঞানীরা ইতিহাস জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, জীবাণু, ভাইরাস এবং গ্যাস সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছেন।
গবেষকরা এই বরফের বয়স নির্ণয়ের জন্য গতানুগতিক এবং নতুন-অভিনব পদ্ধতি সংমিশ্রণে নির্ধারণ করেছেন যে বরফটি প্রায় ১৫,০০০ বছর পুরাতন ছিল।
যখন তারা বরফটিকে বিশ্লেষণ করেন, তখন তারা ৩৩টি ভাইরাসের জেনেটিক কোড খুঁজে পান। এই ভাইরাসগুলির মধ্যে চারটি ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় দ্বারা আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এর মধ্যে কমপক্ষে ২৮ টি একদম নতুন আবিষ্কৃত। আর এর মধ্যে মোটামুটি প্রায় অর্ধেক বেঁচে ছিলো বলে মনে হয়।
ওহাও স্টেট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক এবং ওহাও স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার অব মাইক্রোবায়োম সায়েন্সের পরিচালক, ম্যাথিউ সুলিভান বলেন, “এই ভাইরাসগুলি চরম এবং বিরূপ পরিবেশেও টিকে থেকে সমৃদ্ধ হতে পারে। এই ভাইরাসের মধ্যে এমন সিগনেচার জিন রয়েছে যা তাদের ঠান্ডা পরিবেশে কোষে সংক্রামিত হতে সহায়তা করে। জেনেটিক সিগনেচারটি পরাবাস্তবধর্মী হলেও এটাই তাদের ঠান্ডা পারিবেশি টিকে থাকতে সাহায্য করে। এখন এই সিগনেচার জিন খুঁজে বের করা মোটেও সহজ নয়। ঝি-পিং এর উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতি (অর্থাৎ বরফ টুকরো পরিষ্কার এবং সেখান থেকে অনুজীব এবং ভাইরাস বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি) আমাদেরকে বরফ ঠান্ডা বিরূপ পরিবেশে থাকা অনুজীব এবং ভাইরাসের জেনেটিক সিকুয়েন্স করতে সাহায্য বরবে। সেটা মঙ্গল গ্রহের হোক, চাঁদের হোক কিংবা পৃথিবীর আতাকাম মরুভূমি হোক”
যেহেতু ভাইরাস কমন এবং ইউনিভার্সাল জিন শেয়ার করে না। তাই একটি নতুন ভাইরাসটির নামকরণ করা, এটাকে জানা ভাইরাসগুলির মধ্যে কোথায় ফিট করে তা বের করার চেষ্টা করা সহ একাধিক পদক্ষেপ পার করতে হয়। জানা ভাইরাসগুলির সাথে অজানা ভাইরাসগুলির তুলনা করতে বিজ্ঞানীরা জিন সেটক তুলনা করেন। জানা ভাইরাসের জিন সেট বৈজ্ঞানিক ডাটাবেসে ক্যাটালোজ করা থাকে।
এই ডাটাবেসের তথ্যে সাথে তুলনা করে দেখা গেছে গুলিয়া আইস ক্যাপ থেকে নেয়া আইস কোরে প্রপ্ত ভাইরাসের মধ্যে চারটি ভাইরাস আগে সনাক্ত করা হয়েছিল। এবং এই ভাইরাস মুলত ব্যকটেরিয়া সংক্রমণকারী ভাইরাস পরিবারের অন্তর্ভক্ত।
গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ভাইরাসগুলির সম্ভবত মাটি বা উদ্ভিদের থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, প্রাণী এবং মানুষের থেকে নয়। পরিবেশ এবং জানা ভাইরাসগুলির ডেটাবেস; উভয়ের উপর ভিত্তি করে তারা এ সিন্ধান্তে উপনীত হন।
হিমবাহে প্রাপ্ত ভাইরাস নিয়ে গবেষণা তুলনামূলকভাবে নতুন। এ পর্যন্ত মাত্র দুটি গবেষণাই প্রাচীন হিমবাহ বরফের ভাইরাস চিহ্নিত করেছে। তবে এটি বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্র যা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কেননা এসকল গবেষণা থেকে বিভিন্ন সময় পরিবেশের পরিবেশের পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ধারণ পাওয়া সম্ভব
ওহাও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় বিশিষ্ট অধ্যাপক এবং বাইর্ড সেন্টারের সিনিয়র গবেষক-বিজ্ঞানী লনি থম্পসন বলেন, “আমরা এই চরম এবং বিরূপ পরিবেশে টিকে যাওয়া ভাইরাস এবং জীবাণু সম্পর্কে খুব কম জানি। তবে এই ডকুমেন্টেশন এবং গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস কী এবং কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়? যখন আইস এজ থেকে বর্তমান সময়ের মতো গরমের দিকে যায় তখন কী হয়?’ এসকল প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনেক কিছুর বুঝতে সাহায্য করবে।”
এ ব্যাপারে অনেক কিছু জানার আছে।
গবেষনাপত্র: Glacier ice archives nearly 15,000-year-old microbes and phages, Microbiome (2021)
DOI: 10.1186/s40168-021-01106-w