সম্ভবত জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক এবং আজব এক ধাঁধা হচ্ছে – “জীবন কি?” এর উত্তর খুঁজে বের করা।
জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের একটি বৃহত্তর এবং ক্রমবর্ধমান বিস্তৃত সত্ত্বেও, জীবনের একটি সাধারণ সংজ্ঞা অধরা রয়ে গেছে। সাধারণত জীববিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে (Campbell Biology) পরিচিত জীবের বৈশিষ্ট্যগুলি সংকলন করা সেটাকে ব্যবহৃত করা হয়, যেমন: জীব পরিবেশের প্রতি সাড়া দিন, বৃদ্ধি এবং পরিবর্তন ঘটে, পুনরুৎপাদন এবং বংশবৃদ্ধি ক্ষমতা আছে, জটিল রসায়নের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, হোমিওস্টেসিস বজায় রাখে, কোষ নামক কাঠামো দ্বারা নির্মিত এবং তাদের বৈশিষ্ট্য তাদের বংশধরদের কাছে দিয়ে যায়। উপরন্তু, বেশ কয়েকটি সংজ্ঞা সংক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর জীবনের মৌলিক দিকগুলি সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে, যার মধ্যে বেশ জনপ্রিয় কয়েকটা উদাহরণ হলো:
- জীবন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাসায়নিক ব্যবস্থা যা ডারউইনিয়ান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে সক্ষম (Gerald Joyce, 1994) [NASA এ সংজ্ঞা ব্যবহার কর এটা]।
- জীবন হলো নিম্নতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া (regulatory mechanisms)-র একটি নেটওয়ার্ক যা একটি উচ্চতর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া (potential of expansion)-র অধীনে কাজ করে (Korzeniewski, 2001)।
- প্রাণ অটোপাইসিস প্রতিক্রিয়া যেটি একটি নেটওয়ার্কের কারণে নিজেকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা যা ক্রমাগত উপাদান পুনর্জন্ম করতে সক্ষম (Capra and Luisi, 2014)
প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বিজ্ঞানী ওলেগ আব্রামভের একটি নতুন গবেষণাপত্রে “জীবন কি?” তার এক নতুন সংজ্ঞা বের করেছেন।
Origins of Life and Evolution of Biospheres জার্নালে প্রকাশিত “Emergent Bioanalogous Properties of Blockchain-based Distributed Systems” শীর্ষক গবেষনাপ্রত্রের প্রধান গবেষক অব্রামভ বলেন, “এই গবেষনাটিতে এমন প্রমাণ উপস্থাপন করে যে জৈবিক প্রক্রিয়ার ক্রম পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপারটি মৌলিকভাবে গণনা করা সম্ভব। ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য একটি আশাব্যঞ্জক দিক হল গাণিতিক তত্ত্বের বিকাশ ঘটানো যেটা জীব কীভাবে নিজেদের ক্রম বজায় রাখে তা গণনা করে দিতে সক্ষম।”
হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে অবস্থিত Research Centre for Astronomy and Earth Sciences -এ সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্র Origins Research Institute -এর পরিচালক স্টিফেন মোজসিস এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট গবেষক কার্স্টিন বেবেল উক্ত গবেষণায় সহায়ক হিসেবে ছিলেন।
গবেষণাটি তত্ত্ব, পর্যবেক্ষণ এবং মডেলিংকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়েছে। এখানে তাত্ত্বিক ভিত্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের জীবের মধ্যে স্ব-সংগঠন এবং বিবর্তনের নীতি অন্তর্ভুক্ত করে। এইভাবে, গবেষকরা প্রথম নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে জৈবিক ব্যবস্থার একটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করেন।
আব্রামভ বলেন, “এই কাজটি ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটেড ভার্চুয়াল মেশিনের (dVM) পর্যবেক্ষণ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। মেশিনটি হাজার হাজার নোড বা কম্পিউটারের সমন্বয়ে গঠিত। এই গবেষণার পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে এই ধরনের ডিস্ট্রিবিউটেড ভার্চুয়াল মেশিনের (dVM) কার্যক্রম জৈবিক ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের পর্যবেক্ষণকৃত ব্লকচেইন এবং ডিএনএ (সবার পরিচিত স্ব-প্রতিলিপি তৈরিকরতে পারা অণু যা সমস্ত জীবনের জেনেটিক ব্লুপ্রিন্ট)-এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কার্যকরী এবং কাঠামোগত মিল রয়েছে। ব্লকচেইন হল ব্লক নামক সাব-ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডেটা স্ট্রাকচার, যা উন্নত ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে ‘চেইন’ বা একে অপরের সাথে আবদ্ধ থাকে। বাস্তবে, এটি মূলত একটি অপরিবর্তনীয় মাধ্যম যা কম্পিউটার কোড আকারে নির্দেশাবলী ধারণ করে এবং হাজার হাজার নোড জুড়ে প্রতিলিপি তৈরি করে রাখে অনেকটা কোষের ডিএনএর মতো।”
গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে যে, এই ধরনের ব্লকচেইন-ভিত্তিক সিস্টেম জীবের কিছু মানদণ্ডের সাথে খাপ খায়, যেমন পরিবেশের প্রতিক্রিয়া, বৃদ্ধি এবং পরিবর্তন, প্রতিলিপি এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণ। এছাড়াও গবেষণাপত্রটি একটি ধারণগত মডেল উপস্থাপন হয়েছে যেখানে “জীব” কে একটি সাধারণ স্ব-সংগঠিত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ বদ্ধ সিস্টেম (বদ্ধ সিস্টেম বা বদ্ধ ব্যবস্থা হল একটি ভৌত ব্যবস্থা যা একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের বাইরে পদার্থ স্থানান্তর করার অনুমতি দেয় না) হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে যেটা জীবনের সব সংজ্ঞা পূরণ করে। এছাড়া মডেলটি উন্নয়নশীল প্রযুক্তির বর্ণনা দেয়, বিশেষ করে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক (ANN) ভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)।

ছবি: O. Abramov, Planetary Science Institute
উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ধরনের ব্যবস্থায় জৈবিক জীবনের চেয়ে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অ্যাডভানটেজ থাকবে, যেমন: বংশের অর্জিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য প্রেরণের ক্ষমতা, উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভুলতা কমিয়ে গতি বৃদ্ধি, সেইসাথে সম্ভাব্য সীমাহীন জীবদ্দশা বা অমরত্ব।
পাবলিক ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটেড ভার্চুয়াল মেশিনের (dVM) কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তার অর্থাৎ বাচ্চা AI বিকাশের জন্য একটি অসংযত পরিবেশ সরবরাহ করে, যার ফলে তাদের বিবর্তনকে স্ব-নির্দেশিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ তারা জীবের মতোই বিবর্তিত হতে পার।
গবেষণায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে ব্লকচেইন (যেটা ডিএনএর মতো কাজ করে) এবং ANN- ভিত্তিক AI (যেটা মস্তিষ্কের মতো কাজ করে) ইন্টিগ্রেশন জীববিজ্ঞানের মতোই জটিল সিস্টেম তৈরি করবে।
এখন ব্লকচেইন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির সমন্বয় যদি ‘জীব’ এর সকল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সক্ষম। তাহলে জীবন বা প্রাণ আসলে কী?
তো এবার সেই জীবনের নতুন সংজ্ঞা, এ গবেষণা মতে জীবন বা প্রাণের সংজ্ঞা হলো,
“জীবন হলো একটি স্ব-সংগঠিত, স্ব-নিয়ন্ত্রক সর্বাধিক-এনট্রপি পুনরাবৃত্তিকারী যা স্থিতিশীল বিচ্ছিন্ন কাঠামোর শ্রেণিবিন্যাস দ্বারা গঠিত।”
গবেষণা পত্র: Oleg Abramov et al, Emergent Bioanalogous Properties of Blockchain-based Distributed Systems, Origins of Life and Evolution of Biospheres (2021)
DOI: 10.1007/s11084-021-09608-1