আমাদের মধ্যে একটা খুব সাধারণ কিন্তু অবহেলিত রোগ হলো স্থূলতা। না, এখানে মোটা বলে কাউকে বডি শেমিং করা হচ্ছেনা, এখানে কথা বলা হচ্ছে মোটা হওয়া নিয়ে যা আরও হাজারটা স্বাস্থ্যসমস্যাকে উস্কানি দিয়ে থাকে। আসলে এই স্থূলতার কারণ কী? সহজে বললে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করা যা আমরা খরচ করিনা এবং তা জমা হয়ে থাকে আমাদের শরীরে মেদরূপে। ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যতালিকা ছাড়াও অলস, কায়িক পরিশ্রমবিহীন জীবনযাপন স্থূলতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এই সবকিছুর পিছনে রয়েছে শত শত জিনের কার্যকলাপ।
আসলে আমরা “স্থূলতার পিছনে শত শত জিন দায়ী” বলতে কি বুঝি? সহজে বললে এসব জিন আমাদের গ্রহণ করা অতিরিক্ত ক্যালরি তথা খাদ্যকে মেদ হিসেবে শরীরে জমা করার পিছনে ভূমিকা পালন করে। বিবর্তনীয় উপযোগিতা হিসেবে দেখলে এটা আসলে আশীর্বাদই ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য। তখন একজন সদস্য শিকার/কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে খাদ্যের জোগান করত, সবসময় পর্যাপ্ত খাদ্য পাওয়াও যেত না। এছাড়া দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজে প্রচুর কায়িক পরিশ্রম প্রয়োজন হতো। এই কায়িক পরিশ্রমের জন্য “অধিক ক্যালরি সম্পন্ন খাদ্যগ্রহণ” এবং “অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে জমা হওয়া”, এই দুই ছিলো আশীর্বাদস্বরুপ যা আজকের জন্য অভিশাপ। আজকে কায়িক পরিশ্রম কমেছে ঠিকই কিন্তু ফুড টেস্ট একইরকম রয়ে গেছে প্রায় ক্ষেত্রেই।
এজন্য জিনোমিসিস্টরা উদ্যোগ নিয়েছেন স্থূলতার পিছনে দায়ী জিনগুলো চিহ্নিত করার। যার ফলে ভবিষ্যতে এইসকল জিনের কার্যক্রম ড্রাগ বা অন্য উপায়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যেন অতিরিক্ত স্থূলতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যায়। কিন্তু এই কাজ এত সহজ নয়। তাই Eyleen O’Rourke এবং তার সহযোগীরা একটা পথ খুঁজে বের করেন এইসকল জিনের পর্দা উন্মোচনের।
c. elegans নামক একধরনের কৃমি রয়েছে যারা পঁচনশীল উদ্ভিদে বসবাস করে এবং জীবাণু খেয়ে বেঁচে থাকে। তাদের এবং আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স তুলনা করলে আমাদের প্রায় ৭০% জিন মিউচুয়াল রয়েছে এবং আমাদের মতো তাদের মধ্যেও অতিরিক্ত চিনি, মিষ্টি খাওয়ার ফলে স্থূল হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা যায়। তাই তাদের উপর পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে আকাঙ্ক্ষিত জিনগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করাই যায়। আপনারা হয়তো ভাবতেছেন কৃমির উপর গবেষণা কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তাহলে অবাক হবেন জেনে গত বিশ বছরে তিনটি নোবেল পুরষ্কার এসেছে কৃমির উপর গবেষণা করে (মূলত কিছু কোষীয় প্রক্রিয়া যা প্রথম কৃমিতে শনাক্ত করা হয়) এবং এসকল গবেষণা ক্যান্সার এবং নিউরোডিজেনারেশনের সাথে সম্পর্কিত।
তো এবার আসি C. elegans কীভাবে এই গবেষণায় আশার আলো দেখিয়েছে এবং ভবিষ্যতে স্থূলতা নিয়ন্ত্রণের সহজ দুয়ার খুলে দিতে পারে। O’Rourke এবং তার সহযোগীরা মানুষের স্থূলতার সাথে সম্পর্কিত ২৯৩ টি জিন সন্দেহ করেন এবং কৃমিতে এই জিনগুলোর উপর নজরদারী শুরু করেন কোন কেন জিন আসলেই সম্পর্কিত, কীভাবে সম্পর্কিত এসব বোঝার জন্য। পরীক্ষার ধাপ ছিলো দুইটা:
১) কৃমির স্থূলতার একটা আদর্শ মডেল তৈরী
২) কিছু কৃমিকে রেগুলার ডায়েট এবং কিছু কৃমিকে উচ্চ ফ্রুক্টোজ যুক্ত খাদ্য খাওয়ানো।
এরপর আসে পরীক্ষায় পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা। তো এই ২৯৩ টা জিন থেকে তারা ১৪টি জিন শনাক্ত করেন যেগুলো মেদ বৃদ্ধি করে এবং ৩ জিন শনাক্ত করেন যারা মেদ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। এখানে একটু ক্লিয়ার করে রাখি, মেদ বৃদ্ধি প্রতিরোধ বলতে সহজ কথায় গৃহীত ক্যালরিকে মেদ হিসেবে জমা না করে শরীরের বিভিন্ন কাজে ব্যয় করে ফেলাকে বুঝায়। এখানেই থেমে না থেকে গবেষণাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন গবেষকরা। যে ১৪টি জিন স্থূলতার জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করা হলো ইঁদুরে তাদের একটা জিন ব্লক করে দেখা গিয়েছে:
১) আসলেই স্থূল হওয়ার হার কমে।
২) ইনসুলিন সেনসিভিটি উন্নত করে।
৩) রক্তের সুগার লেভেল হ্রাস করে।
যদিও এখনো প্রচুর গবেষণা বাকী, তবু শুরু হিসেবে এটা অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপক ছিলো বলে জানিয়েছেন গবেষকরা, খুব তাড়াতাড়ি হয়তো আমরা জিনোমিকসের কল্যাণে মানুষের মাঝে স্থূলতা বৃদ্ধির এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। O’Rourke এর ভাষায় বললে:
Anti-obesity therapies are urgently needed to reduce the burden of obesity in patients and the healthcare system, Our combination of human genomics with causality tests in model animals promises yielding anti-obesity targets more likely to succeed in clinical trials because of their anticipated increased efficacy and reduced side effects.
গবেষকগণ: Wenfan Ke, Jordan N. Reed, Chenyu Yang, Noel Higgason, Leila Rayyan, Carolina Wählby, Anne E. Carpenter, Mete Civelek and O’Rourke
ফলাফল প্রকাশ: PLoS Genetics