বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক গবেষণায় প্রায় ২২ মিলিয়ন বছর আগের এখন পর্যন্ত পাওয়া বৃহত্তম স্থল স্তন্যপায়ী প্রাণীরদের মধ্যে অন্যতম দানবাকৃতির গন্ডারের দুটি ফসিল বা জীবাশ্ম আবিষ্কার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত ফসিলগুলো যে গণ্ডার প্রজাতির, তারা আধুনিক গণ্ডারের চেয়ে বেশ বড়। কাঁধের উচ্চতা ২০ ফুটেরও বেশি এবং দেহের ওজন তথা ভন ২০ টনেরও বেশি। এমনকি এরা বিলুপ্ত প্রাণী ম্যামথের চেয়েও বড়, যা কিনা স্থলভাগে এযাবৎকাল বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণিসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ।

এই নতুন ফসিলগুলো উদ্ধার করা হয়েছে ২০১৫ সালের মে মাসে, চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গানসু প্রদেশের লিংক্সিয়া এলাকায়। উদ্ধারকৃত ফসিল দুটির মধ্যে একটি খুলি, চোয়ালের হাড়, দাঁত, “অ্যাটলাস ভার্টিব্রা” (যে অংশটি মাথা ও মেরুদণ্ডকে সংযুক্ত রাখে) এবং অপরটি তিনটি ভার্টিব্রি নিয়ে গঠিত। এই অংশগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই প্রাচীন জন্তুটির ডিজিটাল অবয়ব পুনর্নির্মাণ করেছেন, এবং তাদের কঙ্কালে বিভিন্ন পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন যার ভিত্তিতে প্রাণিটিকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেছেন Paraceratherium linxiaense। প্রথম নামটি দানবাকৃতি গণ্ডারের বৃহত্তর দলের নাম (যে গণের মধ্যে আরো অনেক প্রজাতি রয়েছে), এবং দ্বিতীয়টি হল সেই অঞ্চলের নাম যেখানে ফসিলগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে।

ছবি: Tao Deng
বেইজিংয়ে অবস্থিত Chinese Academy of Sciences এর Institute of Vertebrate Paleontology and Paleoanthropology -র পরিচালক টাও ডেং (Tao Deng) এর ভাষ্যমতে, লিংক্সিয়া অঞ্চলটি ফসিল উদ্ধারের জন্য ‘৫০ এর দশক থেকেই বিখ্যাত৷ তখন স্থানীয় কৃষকরা প্রথমবারের মত সেখানে তথাকথিত “ড্রাগনের অস্থি” খুঁজে পান, যা ঐতিহ্যবাহী ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হত।
ডেং একটি ইমেইলে জানিয়েছেন, তাঁর দল ‘৮০ র দশক থেকেই লিংক্সিয়াতে ফসিল খুঁজে যাচ্ছে এবং এপর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রাণির পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল উদ্ধার করেছে। কিন্তু উদ্ধারকৃত ফসিলে দানবাকৃতি গণ্ডারের সম্পূর্ণ কঙ্কালের কিছু অংশবিশেষ পেয়েছেন মাত্র, যদিও চীনের অন্য জায়গায় বেশকিছু পূর্ণাঙ্গ ফসিলও পাওয়া গিয়েছে।
‘৭০ এর দশকে চীনে উদ্ধারকৃত ফসিল থেকে গণ্ডারের একটি পৃথক প্রজাতি শনাক্ত করা হয়, যার বৈজ্ঞানিক নাম Dzungariotherium orgosense। নতুন শনাক্তকৃত প্রজাতিটি এই প্রজাতির চেয়ে খানিকটা ছোট – ডেং এমনটাই বলেছেন। অবশ্য এটি Paraceratherium bugtiense নামক অপেক্ষাকৃত সাধারণ এবং ছোট প্রজাতিটির (এর প্রথম ফসিল পাওয়া যায় পাকিস্তানে, ১৯ শতকের শুরুর দিকে) তুলনায় পাঁচগুণ বেশি বড়। এই দানবাকৃতি গণ্ডারের প্রজাতিগুলোর কোনোটিরই নাকের ওপর শিং ছিল না, যদিও তারা আজকের দিনের আধুনিক গণ্ডারদের পূর্বপুরুষ।
১৯২০ এর দশকে বিখ্যাত আমেরিকান অনুসন্ধানকারী রয় চ্যাপম্যান অ্যান্ড্রোসের মঙ্গোলিয়া ও চীনে এক অভিযানের পর থেকেই দানবাকৃতির গণ্ডার বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। তাঁর দল প্রায় অনুদঘাটিত গোবি মরুভূমিতে এই গণ্ডারগুলোর ফসিল খুঁজে পান এবং একটি প্রাণির খুলি নিউইয়র্কে ফেরত পাঠান, যা American Museum of Natural History তে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। এই আবিষ্কার এতটাই সফল ছিল যে দানবাকৃতির গণ্ডার জনগণের কল্পনায় বৃহত্তম ডাইনোসরকেও প্রায় ছাড়িয়ে যায় – লন্ডনের কিংস কলেজের ইতিহাসবিদ ক্রিস ম্যানিয়াস এমনটাই বলেছেন।

ছবি: Wikimedia
“এই বিরাট প্রাণিটি পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ানো সর্বশেষ জীবিত দানবাকৃতি প্রাণিদের মধ্যে অন্যতম” – Natural History Museum of Los Angeles County এর প্রত্নতত্ত্ববিদ ডোনাল্ড প্রোথেরো এমনটিই বলেছেন।
তিনি আরো জানিয়েছেন – দানবাকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণিদের অস্তিত্ব বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক সময়কালে খুবই সাধারণ ছিল, কিন্তু প্রায় ৩৪ থেকে ২৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে অলিগোসিন সময়কালে জলবায়ু শুষ্কতর হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার ফলে পৃথিবীর ব্যাপক পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায়, এবং যেসব স্তন্যপায়ী প্রাণি খাদ্যের জন্য এই বনাঞ্চলের ওপর নির্ভর করত তারাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু দানবাকৃতির গণ্ডার আরো কিছু সময়ের জন্য টিকে থাকে। তাদের জীবন ব্যাবস্থার পার্থক্যের কারণে।
ডেং আরো বলেন, দানবাকৃতির গণ্ডারের এই নতুন প্রজাতিটি পাকিস্তান উদ্ধারকৃত ফসিল থেকে শনাক্ত করা প্রজাতিটির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। এদের কোনো নিকটতম পূর্বপুরুষ কোনো এককালে হয়তো তিব্বত অঞ্চলে বিচরণ করত, বর্তমানে আমরা তিব্বতকে যেমনটা দেখি সেরকম উঁচু মালভূমিতে পরিণত হওয়ার আগে – ডেংয়ের উক্তি থেকে এমন সম্ভাবনাই নির্দেশিত হয়।
গবেষনা পত্র: An Oligocene giant rhino provides insights into Paraceratherium evolution. Communications Biology (2021)