বগুড়ার পুকুরে পানি উধাও: মিথ বনাম বাস্তবতা

সম্প্রতি বগুড়ায় একটি পুকুরে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া গর্তে হারিয়ে যায় সে পুকুরের সব পানি ও মাছ। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয় দেশব্যাপী। অনেকে এই ঘটনাকে “অলৌকিক”, ” অস্বাভাবিক” কিংবা এমনই কিছু আখ্যা দিচ্ছে। এ নিয়ে নানারকম গুজবও ছড়াচ্ছে মানুষজন। এদিকে বিজ্ঞানমনষ্ক কেউ কেউ ভাবছেন, এটা হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত “সিংকহোল” সমস্যা।

আসলে কী এটা? এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন গুঞ্জনগুলো সত্য? নাকি আদৌ কোনোটি সত্য কি না? বিস্তারিত জানুন এখান থেকে।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এটা মোটেই কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। ভূতাত্ত্বিক বা জিওলজিক্যাল কারণে এমন ঘটনা হরহামেশাই পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘটে থাকে। তাই একে অলৌকিক কিংবা ওই জাতীয় কিছু বলার সুযোগ নেই। সঠিক ফিল্ড ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে গবেষকরা সহজেই এসবের কারণ খুঁজে বের করতে পারেন।

#bcb_myth: “বগুড়ার পুকুরে যে গর্ত হয়েছে সেটা সিংকহোল।”

মোটেই না। আসলে বাংলাদেশের জিওলজিতে কোনো ধরণের সিংকহোল সম্ভবই না। এর কারণ জানার জন্য চলুন প্রথমে জেনে আসি কোন ধরণের ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে সিংকহোলের মতো ফিচার পাওয়া যায়।

সিংকহোল শুধু এমন জিওলজিক্যাল পরিবেশেই সম্ভব, যেখানে মাটির ঠিক নিচে প্রধানত লাইমস্টোন, ক্ষেত্রেবিশেষে অন্যান্য ক্যালসাইট (CaCO3) কিংবা জিপসাম (CaSO4.2H2O) সমৃদ্ধ সেডিমেন্টারি রক বা পলি পাথরের বিস্তৃত ও গভীর বেড থাকবে। এখানে, রকবেড হলো ভূমির সমান্তরালে পাথরের একেকটি স্তর।

লাইমস্টোন কিংবা এর কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের সেডিমেন্টারি পাথর খুব সহজেই পানিতে ক্ষয় হয়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানিতে দীর্ঘদিন এই ক্ষয় চলতে থাকলে এসব এলাকায় একপর্যায় কাদামাটির নিচে বিশাল ফাঁকাস্থান সৃষ্টি হয়। মজার ব্যাপার হলো, ফাঁকাস্থান ধীরে ধীরে তৈরি হলেও, উপরস্থ মাটি কিংবা স্থাপনার ওজনে হঠাৎ করেই একদিন সবকিছু ধসে পরে সেই বিশাল গর্তে। তৈরি হয় ১ থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত গভীর ছোটো-বড়ো নানা সিংকহোল। এসব সিংকহোলের মুখ সাধারণত গোলাকৃতি হয় এবং ব্যাসার্ধেও এরা বিশাল জায়গা দখল করে।

বাংলাদেশে সিংকহোল সম্ভব না। কারণ, এদেশের কাদামাটির নিচে সিমপ্লি কোনো লাইমস্টোন নেই। বাংলাদেশের বিশাল সমতল ভূমি গঙ্গা ও যমুনা নদীর পলি বা সেডিমেন্ট থেকে তৈরি। তার উপর, সেডিমেন্ট জমে এসব ভূমির উৎপত্তি হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। তাই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সেডিমেন্টগুলো পাথরে পরিণত হতে পারেনি এখনো। আমাদের আলোচ্য বগুড়া অঞ্চলের সার্ফেস এই পলিমাটি দিয়েই তৈরি। এছাড়াও মাটির নিচে যেসব সেডিমেন্টারি রক থাকতে পারে সেগুলো হলো স্যান্ডস্টোন, চার্ট ইত্যাদি। লক্ষ্য করুণ, এসব সমতলে লাইমস্টোনের কোনো বিস্তৃত এলাকা নেই। তাই পুরো দেশের প্রায় কোথাও-ই সিংক হোলে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন না গবেষকরা।

তাহলে কোন পাতালে হারিয়ে গেল বগুড়ার সেই পুকুরের পানি? সত্যি কথা বলতে, এক্সপার্ট ভূতত্ত্ববিদরা ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন করে কোনো উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত অজানাই থেকে যাবে এটা আমাদের কাছে। তবে সম্ভাব্য এক্সপ্লানেশন ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।

ভূতত্ত্ববিদরা আপাতত ধারণা করছেন, সার্ফেসে হঠাৎ উৎপন্ন হওয়া কোনো ফ্র‍্যাকচারের কারণে এই গর্তের সৃষ্টি হতে পারে। গর্ত সংলগ্ন কাদামাটির ঠিক নিচেই বালির স্তর থাকা সম্ভন। কাদা পানিকে শোষণ না করে ধরে রাখতে পারলেও বালির সেই ক্ষমতা নেই। বালির স্তর বেয়ে মাটির গভীরে পানি সড়ে যেতে পারে বলে ধারণা অনেক ভূতত্ত্ববিদের। আর গর্ত যথেষ্ঠ গভীর হওয়ায় পুকুরের সব মাছেরও সমাধি হয়েছে সেখানে।

সমতল ভূমিতে হঠাৎ এমন ফ্র‍্যাকচার সৃষ্টি হওয়াকে সাধারণ ভূতাত্ত্বিক ঘটনা বলেই স্বীকার করেন জিওলজিস্টরা।