ভারতের ওডিশা রাজ্যের সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে দেখতে পাওয়া কালো বাঘের রহস্য উদঘাটন করলো বিজ্ঞানীরা। ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্স এর বাস্তুবিজ্ঞানী ঊমা রামকৃষ্নাণ এবং তাঁর ছাত্র বিনয় সাগর খুঁজে পেয়েছেন উত্তর। মূলত মিউটেশন এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকা ব্যাঘ্রগোষ্ঠীর ইনব্রিডিং কেই এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে, যার জন্যে বেজায় কপালে ভাঁজ পড়েছে বিজ্ঞানীদের। বাস্তবে অতিবিরল হলেও গল্পকাহিনিতে বেশ জনপ্রিয় এই কালো বাঘ।
1993 সালে সিমলিপাল অরণ্য এলাকায় একজন আদিবাসী যুবক যখন আত্মরক্ষার জন্য একটি কালো বাঘকে হত্যা করে তখন চারদিকে আলোড়ন পড়ে যায়। এরপর সেখানে প্রথম ক্যামেরাতে কালো বাঘের গতিবিধি নজরে আসে 2007 সালে। 2018 সালের ব্যাঘরসুমারীতেও বেশকিছু কালো বাঘের ছবি সামনে আসে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো হলুদ ডোরাকাটা হঠাৎ করে কালো কুচকুচে হতে যাবে কেন? উত্তর জানতে হলে জেনেটিক্সের সামান্য ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। জিন হলো এমন এক জৈব রাসায়নিক শৃঙ্খল যা ঠিক করে দেয় যেকোনো জীবের সমস্ত বিবরণ। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির দ্বারা বিভিন্ন জীবের জিনের সুস্পষ্ট শৃঙ্খল কম্পিউটারে বানিয়ে ফেলা যেমন সম্ভব তেমনই কোনও একটি জিনের সামান্য পরিবর্তনের ফলে সেই জীবের দেহের ওপর কী প্রভাব পড়লো সেটাও বের করে ফেলা যায়। এক্ষেত্রেও তেমনটি করা হলে বিজ্ঞানীরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তা হলো, বাঘেদের গায়ের হলুদের বদলে কালো রঙের কারণ হলো Transmembrane Aminopeptidase Q (Taqpep) নামক জিনের মিউটেশন বা আকস্মিক পরিবর্তন। এই মিউটেটেড জিনটি যদিও একটি প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো শাবকের সম্ভাবনা খুবই কম। এখানেও প্রশ্ন চলে আসে তবে এই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য যদি বেরিয়ে আসেও, তবে সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা এখানেই যে সাধারণত বৃহত্তর ব্যাঘ্র প্রজাতির মাঝে এর দেখা মেলেনা। দেখা মিলেছে কেবলমাত্র একটি জায়গা অর্থাৎ সিমলিপাল অভয়ারণ্যে। এই অভয়ারণ্যটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন বাকি সমস্ত অরণ্যের থেকে। সেজন্য এখানকার বাঘেদের বাইরের অন্য জায়গার বাঘেদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কোনও সম্পর্কই নেই। এর ফলে তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই অন্তপ্রজনন ঘটেছে অর্থাৎ সরাসরি রক্তের সম্পর্কের বাঘেদের মধ্যে প্রজনন ঘটার ফলেই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য গুলিও বেরিয়ে এসেছে। এর বাইরে দেশের কোনও অরণ্যে কালো বাঘের দেখা না মিললেও ওডিশার নন্দনকানন উদ্যান এবং আরও দুইটি চিড়িয়াখানায় এই কালো বাঘ তৈরি হয়েছে এবং তাদের জিন ম্যাপিং করেও সিমলিপালের পূর্বপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগের হদিস মিলেছে। সেখানে সমস্যা অতটাও গুরুতর নয় কারণ তারা বদ্ধ পরিসরে রয়েছে। এই অস্বাভাবিক গায়ের রং যুক্ত বাঘেদের সংক্ষেপে বলা হয় সিউডো মেলানিস্টিক বাঘ কারণ মেলানিন নামক এক রঞ্জকের অতিরিক্ত উপস্থিতি এর জন্য দায়ী। বাঘেদের সাধারণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এদের শরীরে হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা দাগ। কিন্তু এই সিউডো মেলামিস্টিক বাঘদের হলুদের উপস্থিতি প্রায় থাকেনা। সাধারণত একসাথে যদি একটি বাঘিনীর 5 সন্তান হয়, তার মধ্যে একটি এমন হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিনের বংশপরম্পরায় অন্তপ্রজনন করার ফলে এই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনে এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত বাঘেদের জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়গুলো বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন সেগুলির মধ্যে প্রথমেই বলা প্রয়োজন ঘন জঙ্গলে, যেখানে গাছের ঘনত্ব খুব বেশি সেখানে শিকার ধরতে এবং চরাশিকারীদের থেকে আত্মরক্ষা করতে সহায়তা করতে পারবে এই জিন। কিন্তু একইসঙ্গে যেহেতু এদের সঙ্গে বাইরের কোনও ব্যাঘ্র জনসংখ্যার যোগাযোগ তৈরি হচ্ছেনা এবং মানবসভ্যতার আগ্রাসন ক্রমবর্ধমান হওয়ার কারণে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ন্যায় বসবাসকারী ব্যাঘ্র প্রজাতি কতদিন টিকে থাকতে পারবে তা বলতে পারা শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিজ্ঞানী রামকৃষ্ণানের কথাতে এই প্রজাতির বাঘেরা অন্তপ্রজনন করার দরুণ অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে, কিন্তু একইসঙ্গে এইধরনের গবেষণালব্ধ ফল ভবিষ্যতে অন্যান্য লুপ্তপ্রায় জীবদের অনেক আগে থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। এই সিউডো মেলানিস্টিক বাঘেদের সঙ্গে যদি সাধারণ বৃহত্তর ব্যাঘ্র জনসংখ্যার মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া যায়, তবেই এই গবেষণার সুদৃঢ় ফলাফল পাওয়া যাবে বলেই তিনি মনে করেন।
গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে: Proceedings of the National Academy of Sciences
DOI: 118/39/e2025273118