আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাসের সমতুল্য লাসসা ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত ৩ জনের খোঁজ মিলল ব্রিটেনে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা একই পরিবারের সদস্য এবং তারা এই রোগের উৎপত্তিস্থল পশ্চিম আফ্রিকা থেকে সদ্য ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্যে একজন সদ্যজাত আক্রান্তের মৃত্যু ঘটেছে বলে জানানো হয়েছে।
ইবোলা সমতুল্য লাসসা ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানানো হয়েছে ইউনাইটেড কিংডম হেলথ সিকিওরিটি এজেন্সি (UKHSA)-র তরফে।
তারা জানিয়েছেন, “আমরা এই আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি এবং জানতে চেষ্টা করছি এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রাখার চেষ্টা করছি তাদের কোনরকম ডাক্তারী সাহায্যের প্রয়োজন কি না, এই রোগের সংক্রমণের পরিধি বোঝার জন্য।”
জানা গিয়েছে ওই পরিবারটি পূর্ব ইংল্যান্ডের বাসিন্দা এবং সদ্যই পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ফিরেছে, সেই অঞ্চলে লাসসা ভাইরাস মহামারী হিসেবে বিবেচিত।
লাসসা ভাইরাস হলো একটি জুটোনিক ভাইরাস অর্থাৎ এই ভাইরাস পশু থেকে মানুষের দেহে ছড়ায়।
সাধারণত মাল্টিম্যামেট প্রজাতির ইঁদুরের দেহে এই ভাইরাস বাহিত হয় তাদের দেহের ওপর কোনও প্রভাব না ফেলেই। এইধরনের ইঁদুর মানববসতির মধ্যেই থাকে এবং এদের লালা এবং মূত্রের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এসবের সংস্পর্শে আসা মানুষের হাত চোখে বা মুখে গেলে বা খাবারের মাধ্যমে শরীরের ভেতরে গেলে বা কোনও ক্ষতের সংস্পর্শে আসলে মানুষের দেহে লাসসা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। আবার নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রশ্বাসের সঙ্গেও ধূলিকণার মাধ্যমে শরীরে সরাসরি প্রবেশ করতে পারে। সেজন্যই পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে লাসসা ভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয় ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলা শুষ্ক মরশুমে।
গোটা বিশ্বে প্রতিবছর ৩০০০০০ মানুষের দেহে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে যার মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকা অন্যতম কারণ সেখানে এই রোগকে মহামারী হিসেবে গণ্য করা হয় এবং গড়ে ৫০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
যেহেতু এই ভাইরাসের প্রবেশের ১ থেকে ২ সপ্তাহ পরে রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করে, সেইজন্য সহজেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের থেকেই এই রোগে আক্রান্তের খবর পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষের দেহ থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ার এখনও কোনও খবর পাওয়া যায়নি। তবে মানুষের দেহের কোনরকম বডি ফ্লুইডের সংস্পর্শে আসলে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে সরাসরি মানুষের দেহে।
UKSHA জানিয়েছেন, “সাধারণ মানুষের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই কারণ এই রোগের সংক্রমণের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি।”
ইংল্যান্ডে প্রথম ইবোলা সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮০ সালে এবং এখনও পর্যন্ত ১৩ টি সংক্রমণের খবর নথিভুক্ত করা হয়েছে। শেষ সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছিল ২০০৯ সালে ২ জন আক্রান্ত হওয়ার।
আফ্রিকার সিয়েরা লিওন এবং লাইবেরিয়ার মোট হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর 15 থেকে 16 শতাংশই লাসসা ফিভারের কারণে।
এই রোগটির নামকরণ হয়েছে নাইজেরিয়ার লাসসা শহরের নাম থেকে কারণ ১৯৬৯ সালে প্রথম এই শহরেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
লাসসা ফিভার কে বলা হয় “ভাইরাসঘটিত রক্তক্ষরণকারী রোগ“, যা ইবোলা-র মতোই। এখন এই রোগের দ্বারা সাধারণত দেহের ভেতর বিভিন্ন তরলের প্রবাহ ব্যাহত হয়। এর ফলে জ্বর, মাথাব্যথা, গলা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই এই সাধারণ উপসর্গগুলো দেখা যায়। কিন্তু বাকি ২০ শতাংশ সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যার মধ্যে গিঁট, যক্কৃত, ফুসফুস, পছেন্দ্রিয় ইত্যাদির সমুহ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে থাকে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বধির হয়ে যাওয়ার ঘটনার নজিরও রয়েছে।
১ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই এই রোগ প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যদিও এখনও জানা সম্ভব হয়নি ঠিক কী কী কারণে এই রোগটি কিছু মানুষের জন্য সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি করে।
যেহেতু বিশ্বে খুব কম গবেষণাগারে লাসসা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হয়েছে, সেজন্য এর নিরাময়ক খুব কমই তৈরি হয়েছে। যেহেতু কোনও প্রতিষেধক নেই, তাই UKHSA এর তরফে এই রোগটিকে গুরুত্বপূর্ণ রোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে দ্রুততার সহিত প্রতিষেধক আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে।
কোভিড-১৯ অতিমারীর পর আন্তরজাতিক উড়ান যোগাযোগ চালু হলেও বিশ্বের অন্য কোনও প্রান্তে এই রোগের বেশি ছড়িয়ে পড়া আটকানো যাবে সামান্য উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করলেই কারণ বাইরের কোনও দেশের মানুষের এই রোগের বাহক প্রাণীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের পর্যবেক্ষণ ছাড়া সাধারণ মানুষের আতঙ্কের খুব একটা কারণ নেই বলে মনে করছেন সংলিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।